‘যৌনতা মূলত একটি আদিম প্রক্রিয়া যা অবচেতনভাবে আমাদের একবারে শুরুর দিককার বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমনটা আমাদের মা-বাবার সঙ্গে থাকে। অতীতের কোনো ক্ষত বা ভয় অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত সময়ে ফিরে আসতে পারে। আপনি যদি বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের মধ্যে থাকেন তবে অপরাধবোধ কখনও কখনও কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।’
যৌন সম্পর্কের একান্ত মুহূর্তে একেবারে আদিম আবেগের মুখোমুখি হওয়ার অনুভূতিতে আক্রান্ত হন অনেকে। এ কারণে যৌন মিলনের পর অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিত্তিক সাইট ভাইস যৌন স্বাস্থ্য ও মানসিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে কারণটি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে। ভাইসের প্রতিবেদন অবলম্বনে লিখেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
২৮ বছর বয়সী লেখক জোহরা গত বছর বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে প্রথম মিলনের পর অঝোরে কেঁদেছিলেন। কান্না থামাতে পারছিলেন না তিনি।
এমন না যে তারা সেবারই প্রথম মিলিত হয়েছেন। ১০ বছর তারা একসঙ্গে আছেন, সঙ্গমও করেছেন। তবে জোহরা জানান, ব্যাখ্যাতীত কোনো কারণে বিয়ে পরবর্তী সময়ে সহবাসজনিত কান্না তাদের যৌন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। জোহরার কান্না তার সঙ্গীকে বিভ্রান্ত করে। কোনো আঘাত পেয়েছেন কিনা এমন শঙ্কা থেকে স্বামী তাকে বারবার জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে?’
জোহরা তাকে আশ্বস্ত করেন, সবকিছু ঠিক আছে। অভিভূত হওয়ার স্বাভাবিক অনুভূতি ছাড়া তার আসলে কেমন বোধ হয় তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না।
জোহরা বলেন, ‘বিছানার বাইরে আমরা নিজেদের অনেক ধরনের মিথ্যার মোড়কে ঢেকে রাখি। এখন আমার মনে হয় মিলনের সময়ের অনুভূতিটা বিশেষ। কারণ তখন ওই মুহূর্তে কেবল আমরা দুজন এবং দুজনের মধ্যে একেবারেই ইউনিক এক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আমি জানি না গভীর আবেগ (প্যাশোনেট) শব্দটি এখানে খাটে কিনা, অথবা এমন অভিজ্ঞতার তীব্রতা বর্ণনা করার জন্য আদৌ উপযুক্ত কোনো শব্দ আছে কিনা।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, যৌন মিলনের পর এ ধরনের গভীর আবেগের প্রতিক্রিয়াটি হচ্ছে পোস্টকয়টাল ডিসফোরিয়া (পিসিডি)। এর সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, পরিতৃপ্ত বা সম্মতিপূর্ণ যৌনতার পরে অশ্রুসিক্ত হওয়া বা দুঃখ বোধ করা।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির পিসিডি নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে পিসিডির শিকার হন। আর ৪ শতাংশ বলেছেন, তারা যৌন মিলনের পর নিয়মিত কাঁদেন। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের প্রায় অর্ধেকের পিসিডির অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেকেই ব্যাখ্যাতীতভাবে মাসে একাধিকবার এ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন।
নিউরোসাইকোলজিস্ট জসদিপ মাগো বলছেন, ‘একান্ত দুর্বল মুহূর্তে আমরা আমাদের সর্বাধিক ব্যবহার করা আবেগটিকেই কাজে লাগাই। আর অন্য কারও পাশে নগ্ন শুয়ে থাকাটি আমাদের দুর্বলতম মানসিক মুহূর্তের একটি। এ পরিস্থিতিতে একজন তার সঙ্গীর সঙ্গে নিজের গভীর আকাঙ্ক্ষা ভাগ করে নিচ্ছেন, তাকে নগ্ন দেখছেন, ভালবাসছেন ও নিজেকে পূর্ণ করার জন্য চূড়ান্ত শারীরিক সম্পর্কে যাচ্ছেন। দুর্বলতা আমাদের যৌনতার অন্যতম উপাদান।’
মাগো বলেন, ‘খারাপ খবর পেলে বা ইমোশোনাল কিছু একটা করার পর অনেকে হেসেও ফেলেন। এটা তারা কোনো আনন্দের অনুভূতির কারণে করেননি। ওই মুহূর্তে তাদের কাছে সবচেয়ে সহজলভ্য আবেগ ছিল হাসি, যা দুর্বলতার মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছে। আমার মতো যেসব মানুষের কাছে সহজলভ্য আবেগ কান্না, তাদের ক্ষেত্রে দেখবেন তারা ঝগড়া করার সময়ও কেঁদে ফেলেছেন।’
মাগোর মতে, যে সমাজে যৌনতা ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত, সেখানে যৌন মিলন অনেকের কাছে অভিভূত হওয়ার মতো একটি অভিজ্ঞতা হতে পারে। এর বিশালত্বের কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে কান্না আসতে পারে।
২৪ বছর বয়সের কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট ঋতুপর্ণার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। ১৮ বছরে বয়সে প্রথমবার যৌন মিলনের পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার মতে, ওই বয়সে তিনি ও তার সঙ্গীর কারোই মানসিক প্রতিক্রিয়া সামাল দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা ছিল না। এরপর কয়েক বছরের থেরাপি ও নিজের উপলব্ধি ঋতুপর্ণাকে নিজের আবেগ ও প্রতিক্রিয়া আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে।
তিনি বলেন, ‘পূর্ব ভারতের ছোট এক শহরের রক্ষণশীল পরিবারে বড় হওয়ার কারণে যৌনতার সঙ্গে লজ্জার বিষয়টি জড়িত ছিল। ছোটবেলায় যৌনতা নিয়ে আমার ভীতিকর কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই, যখন আমি নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় যৌনমিলন করতে সক্ষম হই, তখন আমি এমন অবস্থানে আসার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কেঁদেছি। আমার আনন্দটি এখানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানতাম, এখন আমার সঙ্গে একজন মানুষের মতো আচরণ করা হবে।’
কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, সন্তান জন্মদানের পর বিষণ্নতার সম্মুখীন নারীরা যৌনতার পর কাঁদতে পারেন। এর কারণ তখন তাদের দেহে হরমোনের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ঋতুপর্ণা বলেন, অনেকে এটিকে অক্সিটোসিন ও ডোপামিনের মতো হরমোনের ওঠানামা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তবে এ কারণে যৌনতার পরে কান্না মূলত একটি চরম আবেগ প্রকাশ করে হালকা হওয়ার প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জন্য একেবারেই অনন্য। আমি বিষয়টিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। এখন পর্যন্ত আমার কান্নাকাটি নিয়ে সঙ্গীরা ছিলেন খুবই সহানুভূতিশীল। অনেক ক্ষেত্রে তারাও নিজেদের দুর্বল বা অরক্ষিত মনে করা শুরু করেছেন।’
৩২ বছর বয়সী চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌরভ আরেকটি পরিস্থিতি তুলে ধরছেন। তার মতে, কুইয়ারের (ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়) ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী বা হালকা সম্পর্কের সঙ্গীর সঙ্গে যৌনতার পর দুর্বলতার প্রকাশ ঘটানো স্বাভাবিক নয়। আর তাই যৌন মিলনের পর সৌরভের কাঁদতে ইচ্ছা করলেও তিনি সঙ্গীর ঘর ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম আমি অবসাদজনিত কারণে কাঁদতাম। আমি জানি না কেন আমি এতটা যৌনতা প্রিয় মানুষ ছিলাম। সবকিছু আমার জন্য বাড়তি হয়ে যাচ্ছিল এবং আমি আর নিতে পারিনি। তবে আমি কখনও আমার ছেলেসঙ্গীর সামনে কাঁদিনি। এর কারণ হলো আমি আশা করিনি, ওরা বিষয়টি বুঝবে বা বোঝার চেষ্টা করবে।’
২৪ বছর বয়সী বিপণন ব্যবস্থাপক আসমা প্রায়ই অচেনা সঙ্গীর সঙ্গে যৌন মিলনের পর কান্নাকাটি করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, জীবন কি এভাবেই চলবে? আমি কি সবসময় এমন ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কে জড়াবো? আমার জীবনে এটি বাড়তি কী যোগ করছে? যৌনতার সময় এ সবকিছুই আমার ভেতরে চলতে থাকতো এবং শেষ পর্যন্ত আমি কেঁদে ফেলতাম।’
আসমা তার আগের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে যৌন মিলনের পরও কেঁদেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আগের সম্পর্কের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেছি সে কারণেই এটা ঘটেছিল। এতসময় ধরে তার টানা মনোযোগে থাকতে পারার বিষয়টি সত্যিই আমাকে অভিভূত করতো।’
মাগোর মতে গভীর আবেগতাড়িত হয়ে পড়ার অনুভূতি নেতিবাচক বা ইতিবাচক দুই-ই হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘অনেকে যৌনতার পর অনেকে কাঁদেন, কারণ যৌনতা সম্বন্ধে তাদের ধারণার সঙ্গে অভিজ্ঞতার কোনো মিল থাকে না। খারাপ যৌন সম্পর্ক অনেক সময় সম্পর্কের পদ্ধতিটিকে মনে করিয়ে দেয়। এর ফলে অনেকে চরম আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।’
যৌনতা ও যৌন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আস্থা ভোহরা বলেন, যৌনতার পরে কেন অনেকে কান্নাকাটি করে তা বুঝতে হলে যৌনতার সময় যে উদ্বেগ সেটিকেও আমলে নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় নারীকে পর্যাপ্ত মাত্রায় লুব্রিকেটেড নাও করা হতে পারে, যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। এটা বাড়তে বাড়তে কান্নায় পরিণত হয়। সম্মতিমূলক যৌনতা আমাদের প্রায় সব আবেগের একটি চ্যানেল, কারণ ওই সময়টিতে আমরা আক্ষরিক অর্থেই নগ্ন থাকি। এটি আপনাকে উদ্বেগ ও আবেগ প্রকাশের জন্য নিরাপদ একটি জায়গায় পৌঁছে দেয়। অনেকের জন্য, সেই নিরাপদ জায়গাটি অন্য কোথাও নাও থাকতে পারে।’
ইন্টিমেসি কোচ পল্লভি বার্নওয়াল আরও বলেন, যারা যৌনতার পরে কান্নাকাটি করেন, তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো বাইরে মানসিকভাবে নিজেকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে চলেন। কারও বেড়ে ওঠার দিকে তাকালেও অনেক কিছু বোঝা যায়।
তিনি বলেন, ‘যৌনতা মূলত একটি আদিম প্রক্রিয়া যা অবচেতনভাবে আমাদের একবারে শুরুর দিককার বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমনটা আমাদের মা-বাবার সঙ্গে থাকে। অতীতের কোনো ক্ষত বা ভয় অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত সময়ে ফিরে আসতে পারে। আপনি যদি বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের মধ্যে থাকেন তবে অপরাধবোধ কখনও কখনও কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।’
কোনো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আসন, শব্দ বা যৌনতার অন্য বিষয় অতীতের যৌন আঘাতকে উসকে দেয়। এটিও কোনো ব্যক্তিকে কান্নার দিকে পরিচালিত করতে পারে। বার্নওয়াল এসব ক্ষেত্রে থেরাপির গ্রহণের মাধ্যমে ‘মূল কারণ’ মোকাবিলার পরামর্শ দেন।
নিউরোসাইকোলজিস্ট মাগোর মতে, যৌনতার পর কান্না কোনো ধরনের অসুখ, সমস্যা বা উপসর্গ নয়। তিনি বলেন, ‘যৌনতার পর কান্না কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে ব্যহত করে না। যদি করে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।’
বার্নওয়ালের মতে, যৌনতার পরে কান্নার ঘটনাকে ঘিরে অস্পষ্টতা ও অভিজ্ঞতার বিস্তৃতি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যৌনতা একটি বহু-স্তরযুক্ত বিষয়, যেখানে সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বোঝা যায় না।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি বিষয় বুঝতে হবে, আর তা হলো, যৌনতা বিপরীতমুখী দুটি বিষয়ের মিশেল। এই দুটি বিষয় হলো আনন্দ ও বেদনা। আপনি কীভাবে বিষয়টিকে সামাল দেন বা কীভাবে আপনার সঙ্গী পুরো প্রক্রিয়ার সময় আপনাকে সহায়তা করছে তার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু।
‘যৌন মিলনের পর আপনার সঙ্গীর কান্নায় ভেঙে পড়া দেখলে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। অধিকাংশ সময়ে ব্যাপারটি আপনাকে নিয়ে নয়। সে সময়ে তাকে আগলে রাখুন ও ভালোবাসুন। যৌনতার পর অরক্ষিত বোধের অনুভূতি একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়।’
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।